রোযার মাস যতই এগিয়ে আসছে, ততই আমার মাথার মধ্যে এই চিন্তাটা ঘুরপাক খাচ্ছে:
“আমরা কি রোযার মাস থেকে কি কোনো লাভ আসলেই পাচ্ছি? নাকি রোযার মর্মার্থটা আসলে কী সেটাই বুঝতে পারছি না?”
আমরা কীভাবে বুঝব যে আমরা সত্যিই এই রোযার মাস থেকে উপকৃত হচ্ছি কি না?
আসেন এই ছোট্ট একটা পরীক্ষা করি:
- আমার শরীরের ওজন পুরো মাস রোজার আগে এবং পরে কি একই থাকে? নাকি অথবা ৩০ দিনের উপবাসের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় আমার ওজন আরো কয়েক কিলোগ্রাম বাড়িয়ে দেই?
- আমার ব্লাড সুগার-কোলেস্টেরল-প্রেশার-গ্যাস্ট্রিক, টেনশন-দুশ্চিন্তা-ডিপ্রেশন, ইত্যাদি কমার বদলে কি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো খারাপ হয়ে যায়?
- রমজানে আমাদের মাসের খাবারের খরচ কি আরো বেড়ে যায় উল্টো যেখানে দিনে এক বেলার খাবার কম খাওয়ায় খরচ কমার কথা?
- আমি কি রমজান মাসে সিনেমা এবং অন্যান্য অনৈসলামিক টিভি প্রোগ্রাম দেখা সাময়িক স্থগিত করে দেই এবং আর মনে-মনে প্লান-প্রোগ্রাম সেট করা রাখি রমজান-পরবর্তীতে আগের সব মিস করা মুভি-টিভি সিরিয়াল দেখে ফেলার?
- আমাদের দেশের বাজারে খাবারের দাম কি বেড়ে যায় কারণ আমরা আরও বেশি বেশি খাবার-দাবার কিনি এবং ইফতার ও সেহরির সময় অতিরিক্ত বেশি খাই (অথচ যেখানে রোযার নিয়ম অনুসারে আমাদের খাওয়া কমানোর কথা তিন ভাগের এক ভাগ -যেটা হলো দুপুরের খাবার)?
- রোযার মাস শুরুর আগে কি আমার মনটা খারাপ হয়ে উঠে যে আমাকে এখন সেহেরীর জন্য তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে হবে এবং আমার যত "নিয়মিত" অভ্যাস সেগুলো বাদ দিতে হবে?
- আমার কাপড়-চোপড় কি একটু বেশি ঢিলা ঢালা আর মাথাটা একটু বেশী ঢেকে রাখি কিন্তু রোযার মাসের পর সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আগের জায়গায় ফিরে নিয়ে আসার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠি?
- রমজান শেষে "স্বাভাবিক" জীবনে ফিরে যাওয়ার জন্য কি আমার মনটা অস্থির হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে?
উপরের এই কথাগুলির মধ্যে যদি একটাও সত্য হয়, তাহলে আমার চিন্তা করার সময় এসেছে যে রোযার মাসের উপকারিতা আমি আসলে বুঝতে পেরেছি কিনা।
আমি যদি রোযার মাহাত্ম্য সম্পর্কে তেমন কিছুই গভীর ভাবে নাও জানি - তাহলেও অন্তত এইটুকু জেনে রাখি যে:
রোযা হলো এক মাস ব্যাপী মিলিটারী-স্টাইেলর তাকওয়ার ট্রেইনিং, যেই ট্রেইনিং এর পরে আমাদের জীবনে একটা দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখতে পারার কথা। আপনি কি কখনো একজন বিএমএর ট্রেইনিং করা ক্যাডেট কে দেখেছেন? একজন বিএমএর ট্রেইনিং পাওয়া ক্যাডেট যেমন ট্রেইনিং এর আগে থাকেন একরকম আর ট্রেইনিং এর পরে বিএমএ সার্টিফিকেট পেয়ে তাঁরা একেকজন হয়ে উঠেন শক্ত-সামর্থ্য দেশপ্রেমিক অফিসার - ঠিক সেইরকম ভাবে রোযাও হলো ৩০-দিনব্যাপী ৩০-ডোজের এক বাৎসরিক শারীরিক ও মানসিক ট্রেইনিং; তাকওয়া অর্জনের এক মহা-ট্রেইনিং:
সূর্যোদয়ের অনেক আগে উঠে সেহেরী খাওয়া, সব ধরনের মিথ্যা-খারাপ কথা-ঝগড়া ঝাটি-পরচর্চা-নোংরামী-অন্যায়-সুদ-ঘুষ-ইত্যাদি বন্ধকরা, বেশি বেশি দান-সদকা করা, কোরআন ও হাদিস পড়া এবং তার থেকে শিক্ষা নেয়া, সারাদিন না খেয়ে (অটোফ্যাজি) থেকে ধনী-দরিদ্র সবাই মিলেমিশে ইফতার করা, রাতজেগে এক ঘণ্টার উপর তারাবীহ পড়া আর কোরআনের আয়াত থেকে শিক্ষা নেয়া, আরো কতো কি! আর এর মাধ্যমেই মহামূল্যবান তাকওয়া অর্জন করা। তাকওয়া কী? তাকওয়া হলো সেটাই যেটা থাকলে আমার প্রতিটি কাজের মধ্যে আল্লাহ সচেতনতা এবং আল্লাহর ভয় থাকবে, আল্লাহ্ ছাড়া আর কাউকেই ভয় পাবো না আর আল্লাহর সাহায্য ছাড়া অন্য কারো সাহায্যের উপর ভরসা করবো না। সে যেই হোক - আমার এলাকার রাজনৈতিক নেতা, পাড়ার মাস্তান, দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, অফিসের বস, ... কাউকেই না। রোযার মাসের শেষ দিনটি হলো রোযার সেই কাংক্ষিত সার্টিফিকেট নেয়ার দিন।
যদি কোন কারণে এই বছর সেই কাংক্ষিত সার্টিফিকেট-টা অনেকের কাছেই পাহাড় ডিঙানোর মতো অধরা মনে হয়, যদিও তাতে ক্ষতিগ্রস্থ্য শুধু আমিই হবো, তাহলেও অন্তত রোযার দুনিয়ার শারীরিক উপকারীতাটা জেনে রাখি: রমজান মাস হলো মানুষের জন্য সুস্থ জীবনযাত্রার ৩০ দিনের ৩০-ডোজের প্রেসক্রিপশনের এক অসাধারণ ওষুধ। বৈজ্ঞানিক ভাষায় যাকে বলে অটোফ্যাজি - জাপানি বৈজ্ঞানিক ইউশিনোরি ওশুমি যেটা আবিষ্কার করেছেন ২০১৬ সালে। আর তার পরবর্তীতে পুরো পৃথিবীর মানুষ ঝাপিয়ে পড়েছে এর উপকার নেয়ার জন্য। ওরা একে বলে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং (https://en.m.wikipedia.org/wiki/Autophagy)।
অতকিছু যদি নাও চিন্তা করি তাহলে অন্তত জাগতিক এই অসাধারণ সুবিধাটি নিয়েই নাহয় এই বারের রোযা টা শুরু করা যাক - যদিও তাকওয়া অর্জনই হোক আমাদের সবার আসল উদ্দেশ্য।
No comments:
Post a Comment