গণতন্ত্র নাকি নির্বাচন? নাকি উন্নয়ন? নাকি অধিকার? নাকি শুধুই একটা "কোদাল"?
আরেকটি নির্বাচন চলে গেল। আপনার-আমার মতো অনেক মানুষই নিজেদের কপাল চাপড়িয়ে হাহাকার করে উঠে গনতন্ত্র হারানোর কষ্টে। আড্ডা ও ফেইসবুকে আরেকটা পোস্ট তুলে দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করি আমাদের ভেতরের চরম হতাশাটাকে। বাংলাদেশ যেন আরো-একবার গণতন্ত্রের অভীষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছে যাবার সূবর্ণ সুযোগ হারালো। যেন এই নির্বাচনটা ঠিকঠাক হলেই আমাদের অবস্থা হয়ে যেতো রুপকথার সেই রাজ্যের মতো- "...অতপর তারা মহা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো"। আমরা কখনো ভেবে দেখেছি কি যে আমরা আসলে কী হারালাম? গণতন্ত্র, নাকি একটা নির্বাচন? ব্যাপারটা আসলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। চলেন, দেখি ব্যাপারটা আসলে কী।
এটা ঠিক যে, নির্বাচন এবং নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতি কয়েক বছরে সরকার পরিবর্তন করা কে গণতন্ত্রের একটা ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমনটি আমরা পশ্চিমা বিশ্বে দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু অনেক সময় আমরা নির্বাচনটাকেই সম্পুর্ণ গণতন্ত্র বলে ভুল করে ফেলি। তাই নির্বাচন না পেলে আমরা গনতন্ত্র হারিয়েছি ভেবে বিলাপ করতে থাকি। আমরা কি আসলে নির্বাচন চাই নাকি গনতন্ত্র চাই? আমাদের কি গণতন্ত্র দরকার নাকি গণতন্ত্রের মাধ্যমে অনেক কিছু অর্জন করা দরকার? আমাদের লক্ষ্যটা আসলে কী?
নির্বাচনটা অথবা গনতন্ত্রটাই যদি মূখ্য উদ্দেশ্য হয়ে যায়, তাহলে সেটাকে তুলনা করা যায় অনেকটা এরকম- একটি গ্রামে গোসল, কাপড় ধোয়া, সাঁতার কাটা ইত্যাদি নিত্যদিনের ব্যবহারের জন্য একটা পুকুরের দরকার পরলো। কয়কজন জ্ঞানী মানুষ ওদেরকে জানালো যে কোদাল দিয়ে খুব সহজেই একটি পুকুর কাটা যায় যেখানে লোকজন পানি জমিয়ে রাখতে পারবে ওইসব নিত্যকর্মের জন্য। তো এখন লোকজন যদি পুকুর কাটা শুরু করার পর, কোদাল ঠিক মতো ব্যবহার করা হলো কিনা তাই নিয়ে লেগে যায় আর পুকুর কাটাকে ভুলে যেয়ে ওই কোদালটাকেই, যেটা শুধুই পুকুর কাটার সামান্য একটা উপকরণ বৈ কিছুই না হওয়ায় কথা, সেটাকেই একমাত্র লক্ষ্যে পরিণত করে, তাহলে কেমন লাগবে? আমাদের অবস্থা হয়েছে অনেকটা সেরকম। পুকুর টুকুর খ্যাতায় যাক! আমার দরকার সেই কোদাল! অন্য আর কোনো যন্ত্র হলে চলবে না। আমার সেই কোদালই চাই। বুলডোজার দিলেও না!
এতো ভুমিকা-ভনিতা করে বলার কারনটা খুলে বলি।
বাংলাদেশের জনগণ আসলে কী চায়? আমরা আসলে কি চাইছি? নাগরিকদের জন্য মৌলিক অধিকার (খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি), ধর্মের স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, সরকারের জবাবদিহিতা আর সামাজিক ন্যায়বিচার- তাইতো চাইছি? তাই না? গণতন্ত্রকে আমরা ওইসব নাগরিক অধিকার গুলি অর্জনের বাহন বলে মনে করি। পশ্চিমা বিশ্বের দিকে তাকালে আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হয়। কথাটা অনেকে ক্ষেত্রেই অসত্য না। তাই আমরা সামনে পিছনে কোনো দিকেই না তাকিয়ে গনতন্ত্রের জন্য জান-কোরবান করে যাচ্ছি। আমাদের সকল সমস্যার একমাত্র সমাধান মনে করে। সেটা কি আসলেই সত্যি? গণতন্ত্রই কি একমাত্র "কোদাল"? আর কোনো "কোদাল" কি নেই? অথবা বুলডোজার? গণতন্ত্রের মাধ্যমে যদি আমরা পূর্বে উল্লেখিত লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে পারি তাহলে ভালো। খুবই ভালো। কিন্তু গণতন্ত্র কী বা কোথা থেকে এলো তা নিয়ে আমরা কখনও গভীরভাবে চিন্তা করেছি কি? অথবা কেই বা আমাদেরকে বলে দিলো যে প্রতিটি দেশ পরিচালনার সর্বসময়ের একমাত্র "কোদাল" হল গনতন্ত্র এবং গনতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতি? আর কোনো তন্ত্র-মন্ত্র কি নেই? সেটা বলার আগে আসেন একবার দেখি গনতন্ত্রের নামজারী-
গনতন্ত্রের শুরু হয়েছিল কয়েক হাজার বছর আগে। গ্রীস দেশে। গ্রীকদের গণতন্ত্রের রূপটা ছিল এরকম- কেবলমাত্র নগরবাসী- প্রশিক্ষিত পুরুষদেরই ভোটাধিকার ছিলো। সেই পুরষ-নাগরিকদের বাধ্যতামূলকভাবে দেশের পরিচালনা ব্যবস্থায় যুক্ত থাকতে হতো। কোন অশিক্ষিত-অপ্রশিক্ষিত বা গ্রামবাসী পুরুষ, কোন মহিলা অথবা ক্রীতদাস- কেউই কিন্তু সেই গনতন্ত্রের অংশীদার ছিল না। স্পয়েলার-এলার্ট (সংবিধিবদ্ধ সতর্কবাণী): আমেরিকার প্রথম গনতন্ত্র কিন্তু শুরু হয়েছিল এভাবেই - শেতাঙ্গ-পুরুষ নাগরিকরাই শুধুমাত্র ভোট দিতে পারতেন- মহিলা, বাচ্চা, দাস, অথবা কোনো অশেতাঙ্গ পুরুষ সেই গনতন্ত্রে অংশগ্রহণ করতে পারতোনা। এটা কি আজকের দিনের মতো গণতান্ত্রিক শোনাচ্ছে? অবশ্যই নয়। এটাকেতো পুরুষতান্ত্রিক অসাম্য সমাজ ব্যবস্থাই মনে হতে পারে। তদুপরি, অ্যারিস্টটল-প্লেটো, যাঁদেরকে পশ্চিমা সভ্যতার ভিত্তি-দার্শনিক ধরা হয় তাঁরা নিজেরাই উল্লেখ করেছেন যে গণতন্ত্র মূলত হচ্ছে আম-জনতার শাসন, যেটা অনিবার্যভাবেই একটা দেশকে স্বৈরতন্ত্রের দিকে নিয়ে যায়। অবাক হচ্ছেন তাই না? এটা কি জানেন যে আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট, জর্জ ওয়াশিংটন, নির্বাচিত হয়েছিলেন জনগণের ভোট ছাড়াই? শুধু তাই নয়, এখনও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন পরোপরোক্ষভাবে- যেটাকে বলা হয় "ইলেক্টোরাল কলেজ"। সেই জন্য লক্ষ লক্ষ ভোট কম পেলেও একজন এখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে যায়। ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ছিলেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে আটাশ লক্ষ ভোট কম পেয়ে। হ্যাঁ- কম ভোট পেয়ে। বিশ্বাস না হলে নিজেই যাচাই করুন (https://en.m.wikipedia.org/wiki/2016_United_States_presidential_election)। এটা নতুন কিছু নয়- এটাই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ব্যবস্থা। এটা বুঝতে হলে আপনাকে আমেরিকার রাষ্ট্রের ব্যবস্থা ও তার ইতিহাস পড়তে হবে। সে এক বিরাট ইতিহাস। তাহলে কে আমাদেরকে সেই গনতন্ত্রের "কোদাল" ধরিয়ে দিলো আর আমরা শেষ চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে গনতন্ত্রের "কোদাল" চালিয়েই চলছি? তিহাত্তুর-উনাশি-ছিয়াশি-আটাশির সরকার-দলীয় নির্বাচন, নব্বইয়ের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে "সূক্ষ্ম কারচুপির" নিরপেক্ষ নির্বাচন, পঁচানব্বইয়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন, দুই হাজার সালের নির্বাচন, দুই হাজার আটের মিলিটারি-নির্বাচন, এরপর আরো কতো নির্বাচন! আমরা দেখেও দেখি না! দুই তিনটা ভালো নির্বাচন তো আমরা পেয়েছিলাম, তাই না? কোনো নির্বাচনই কেন আমাদেরকে গনতন্ত্র অথবা এর আগের বলা নাগরিক অধিকারগুলো দিলোনা? আমরা কি দেখেও দেখি না! আমাদের কি সময় হয়নি একটু গভীরভাবে চিন্তা করার? আমাদের কি সময় হয়নি গা-ঝাড়া দিয়ে উঠার?
বাকিটা পরের পর্বে। ইনশাআল্লাহ।
No comments:
Post a Comment