Thursday, November 10, 2022

বাঙ্গালী জাতির ইতিকথা

বাংলাদেশে থাকার সময়, নব্বই দশকের একেবারে শেষের দিকে বিভিন্ন কাজে এবং তারপরে চাকরির কারনে আমাকে মতিঝিলে অফিসপাড়াতে প্রতিদিন বাসে করে যাতায়াত করতে হতো। তো একদিন সচরাচর অন্য যেকোনো দিনের মতো করেই বাসে মতিঝিল যাচ্ছি আর বিভিন্ন মানুষের জটিল জটিল বিষয়ভিত্তিক আলোচনাগুলো শুনছি। আমার এখনও পরিষ্কার মনে পড়ে, কী একটা ব্যাপারে কথা বলার মধ্যে একজন লোক বলে উঠলো-


"আরে এই বাঙ্গালী জাতটাই খারাপ!"


আমি সচরাচর অন্য অপিরিচিত একজনের কথার মধ্যে ঢুকে পড়াটাকে শোভনীয় মনে করি না , যদি না আমি আগে থেকেই সেই আলোচনার অংশ থাকি। তবে সেবার এই কথা টা শুনে আমি আর মেজাজ ধরে রাখতে পারলাম না। আমি বললাম-


"ভাই আপনি তো বাঙ্গালী সম্মন্ধে বেশ ভালোই জ্ঞান রাখেন। আর আমারতো মনে হয় আপনি নিজেও একজন বাঙ্গালী। তাহলে পুরো বাঙ্গালী জাতটাকে না টাইনা বলেন যে - ‘আমিই আসলে খারাপ!‘“


যাইহোক, আসল কথায় আসি। আমরা অনেক সময় বুঝে না-বুঝে মহোৎসবে বাঙ্গালীর চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করায় নেমে পড়ি। একটু ভালো ভাবে খেয়াল করলে দেখবেন যে, আমরা যারা এই বিশেষন গুলো হরহামেশা ব্যবহার করি তারা খুব সযত্নে নিজেকে "ওইসব বাঙ্গালী" থেকে আলাদা করে রাখেন।


ঐসব মানুষেরা আমাদেরকে প্রায়ই বাঙ্গালী জাতির এই বিশেষন গুলো মনে করিয়ে দেয় - যেমন:

"বাঙ্গালী হুজুগে জাতি!”

বাঙ্গালী মাগনা পাইলে আলকাতরাও খায়!"

"বাঙ্গালী অযথাই কলহ প্রবন!"

আর সবসময়, সবচেয়ে বাজে জিনিসটার সাথেবাংলাবিশেষনটা না লাগালে যেনো আমাদের মন ভরে না। কয়েকটা উদাহারন খুব প্রচলিত ছিলো - “বাংলাসিনেমা, “বাংলানায়ক, “বাংলামাল, ইত্যাদি ইত্যাদি।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ পড়ার সময়, প্রফেসর ডঃ মিজান স্যার (বড় মিজান স্যার) যাঁকে আমরা অনেকেইবাংলাদেশের কটলারবলে ডাকতাম আর যারা ওঁনার ক্লাস পেয়েছেন তারা একবাক্যে স্বীকার করবে যে বাংলাদেশে মার্কেটিং বিষয়ে ওনার চেয়ে ভালো পড়াতে পারে তেমন শিক্ষকের সংক্ষা হবে খুবই হাতে গোনা। একদিন বাঙ্গালী নিয়ে মজা করতে গিয়ে এক বিখ্যাত সাহিত্যিক এর উক্তি কোট করে মিজান স্যার বলেছিলেন যে, "...বাঙ্গালী সর্বদা ঝগড়া-বিবাদে মত্ত থাকিত" যদিও আমার কিছু একটা বলার খুব ইচ্ছে হয়েছিল কিন্তু স্যার কে প্রচন্ড সম্মান করার জন্য সেদিন কিছু বলতে পারিনি। আমার সন্দেহ আছে, পৃথিবীতে খুব বেশি সফল জাতি পাওয়া যাবে কিনা যারা নিজের জাতকে ধরে এইভাবে টানাটানি করে।


আমার সবসময়ই ইতিহাস দিকে তাকাতে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানকে বুঝতে ফ্যাসিনেটিং লাগে। বাংলার অতীত গৌরব ব্যর্থতার ইতিহাসের দিকে তাকালে আমাদের আশি নব্বই দশককে খুবই ম্রিয়মান মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার সবসময়ই মনে হতো - কবে আমরা আবার পৃথিবীর মানচিত্রে বন্যা-মহামারির দেশের তকমা থেকে মুক্তি পাবো? কবে আবার মাথা তুলে দাড়াতে পারবো, চোখে চোখ রেখে পৃথিবীর আন্য সব মানুষদের সাথে কথা বলতে পারবো?


কাজের কারনে একসময় আমেরিকাতে আসতে হয়েছে। এখানে আসার পর দেখি, এরা নিজের দেশকে নিয়ে প্রচন্ড গর্বিত। প্রথম প্রথম কেমন যেনো একটু অস্বাভাবিক লাগতো। পরে বুঝলাম এদের গত কয়েক শতাব্দীর অনেক সাফল্য এদেরকে নিজের দেশকে নিয়ে গর্বিত হতে শিখিয়েছে। আমার মনে আছে, ২০০৭ সালের দিকে আফিসে যেতাম কমিউটার ট্রেনে করে। কলকাতার একজন বাঙ্গালী ভদ্রলোকের সাথে প্রায়ই দেখা হতো। আর দেখা হলেই শুরু করতোআহারে বাংলাদেশ কতো কষ্টে আছেদুই বাংলা যদি এক থাকতো তাহলে বাংলাদেশের এতো কষ্ট থাকতো নাইত্যাদি ইত্যাদি" আমার নিজের দেশকে নিয়ে তার এইঅতি সমবেদনামাঝে মাঝে অসহ্য লাগতো। আমি মাঝে মধ্যে ওনাকে এড়ানোর জন্য ট্রেনের সবচেয়ে শেষ কম্পার্টমেন্টে যেয়ে বসতাম। কিন্তু প্রায়ই দেখা হয়ে যেতো। একদিন ভাবলাম অনেক হয়েছে, এইবার এর একটা উচিত জবাব দেয়া দরকার। অনেক ঘাটাঘাটি করে বাংলাদেশের আর ভারতের কিছু স্টাটিসটিকাল তুলনামূলক উপাত্ত জোগাড় করা শুরু করলাম। দেখলাম আমাদের দেশ বেশ কিছু ক্ষেত্রেই ভারতের দিক থেকে এগিয়ে আছে, যেমন - স্যনিটেশন, বিশুদ্ধ পানির, মাতৃ শিশু মৃত্যুর হার, ইত্যাদি। তো এরপর যেদিন আরেকবার দেখা হলো আর অভ্যাসবশত বাংলাদেশ নিয়ে যেই না তিনি উহু-আহা শুরু করলেন, তখনই ওনার মুখের উপর গড়গড় করে ছেড়ে দিলাম আামার সব মুখস্থ করা স্টাটিস্টিক্সের ভান্ডার। এখনো চোখের সামনে ভেসে উঠে সেইদিনটা - বাঙ্গালী ভদ্রলোকের মুখ অনেক্ষন ধরে হা হয়েই থাকলো। বেশ কিছুক্ষণ লাগলো ওঁনার এটা হজম করতে। প্রথমত উনি হয়তে আসলেই যানতেন না যে বাংলাদেশ ভারতের দিক থেকে এগিয়ে আছে অথবা ঘুনাক্ষরেও ভাবতে পারেনাই যে আমি এরকম ডাটা-উপাত্ত সহকারে আক্রমণে যাবো। যাই হোক - সেদিন আমি বাকি সময়টা অপার তৃপ্তিতে জানালা দিয়ে প্রকিৃতি উপভোগ করতে করতে অফিসের পথে চললেম। আহা! কি আনন্দময় ছিলো সেই দিনের অফিস যাত্রা।




ফাস্ট ফরওয়ার্ড - এখন আমাদের দেশের মানুষের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমার এক জীবনেই দেশটাকে অনেকটা বদলে যেতে দেখলাম। দেখতে ভালো লাগে যে আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন অনেক সাহসী। নিজের দেশকে নিয়ে ওরা অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখে। দেশকে এগিয়ে নিতে ওরা দিনরাত কাজ করে চলছে। এই পরিবর্তনটার পিছনে অনেক কারন আছে যেগুলো বলতে গেলে একটা বই লিখে ফেলতে হবে তাই সেটা অন্য কোনো দিনের জন্য তুলে রাখলাম। তবে অল্প সময়ের মধ্যে যদি বলতে হয় তাহলে বলা যায় - শত বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব কাটাতে আমাদের কয়েক দশকেরও বেশী লেগে যাওয়া খুব বেশী তৃপ্তিদায়ক না হলেও অস্বাভাবিক নয়। ব্রিটিশদের ঝেটিয়ে তাড়িয়ে দেয়া ছিলো প্রথম অর্জন তারপর মুক্তিযুদ্ধ দিয়ে আমাদের শুরু। স্বাধীনতা আমাদের প্রথম গর্ব। আমাদেরমানব জীনোম" থেকে হীনমন্যতা ধোয়ামোছার শুরু সেখান থেকেই। যদিও আশি নব্বই দশক কে খুবই ম্রিয়মান বলেই ধরে নেয়া হয় - এবং সঙ্গত করনেই তা নেয়া হয়। কিন্তু আমার মতে সেই সময়গুলোই ছিলো বাংলাদেশের ভিত্তি তৈরি করার কাল - হেনরি কিসিন্জাররে তলাবিহীন ঝুরির অপবাদ থেকে উত্তরনণের যাত্রা। কৃষি কৃষকদের দিকে মনোযোগ, উচ্চশিক্ষায় মানুষের আগ্রহ, পরিবার-পরিকল্পনায় সরকারী প্রকল্প, স্যানিটেশন, শিশুদের টিকা, শিশু মায়ের মৌলিক সাস্থ্য-ব্যবস্থার নিশ্চিয়তা, খাবার স্যালাইন আার মাটি মানুষের মতো সচেতনমূলক প্রচারনা, সারাদেশে রাস্তা-ঘাট-ব্রীজ-কালভার্ট বানানো, গার্মেন্টস ইনডাস্ট্রির ব্যপক প্রসার, প্রবাসী শ্রমিকদের আত্মবিসর্জনের বিনিময়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, অর্থনীতির বেসরকারীকরণ, ইত্যাদি। আমি জানিনা বাকি সবাই কীভাবে ভাবেবেন, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, ক্রিকেট খেলাটাও আমাদেরকে সাহায্য করেছে সাহসী হতে - আত্মসম্মানের সাথে অন্য জাতির সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে। আমি সাক্ষী বাংলাদেশর কেনিয়াকে হারিয়ে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিশ্বকাপে যাত্রার। তখন আমি ছাত্র - ঢাকায় থাকি। সারা ঢাকা যেনো রঙে রাঙান্বিত হয়ে গিয়েছিলো - আক্ষরিক অর্থে। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি যেনো ছিলো বিজয় আনন্দের কেন্দ্র। আর বিশ্বকাপে যেয়ে দেখেছি পাকিস্থানকে হারাতে। সেই প্রথম মনে হয়েছিলো - আমরা সব পারি। আমরা যারা বিদেশে থাকি, তাদের যখন আামাদের একসময়ের ঔপনিবেশীকারী সাদা চামড়ার মানুষদের সাথে সমানে সমান হয়ে কাজ করতে হয়, অন্যদের কথা জানিনা, আমি কিন্তু তখন সাহস জোগাড় করি মাশরাফী মুর্তজা, সাকিব আল হাসান, আর মুশফিকদের কাছ থেকে। এই ছোট ছোট অল্প বয়সের ছেলেগুলো যদি ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, আর নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটারদের সাথে সমানে সমানে লড়াই করতে পারে তাহলে আমি কেনো পারবো না? বেশ কিছুদিন যাবত একটা ভিন্ন ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, বিশেষ করে, পাকিস্থানী, ভারতীয়, আর আফ্রিকার কিছু দেশের মানুষদের কাছ থেকে আর সেটা হলো - বাংলাদেশের এই পরিবর্তনের পেছনে রহস্যটা কী? তখন মনটা গর্বে আর প্রশান্তিতে ভরে উঠে। ওঁদেরকে বলি আমাদের বেড়ে উঠার গল্প।


এই পরিবর্তনের কিছুটা যদিও আমাদের সময় থেকেই কিছুটা শুরু হয়েছিলো কিন্তু আমাদের পরবর্তী এই প্রজন্ম সেটাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে অনেকখানি সামনে।আমরা এখন আর বিশ্ব মানচিত্রে নামসর্বস্ব বা অস্তিত্বহীন নই। আমরা পাকিস্থানের চেয়ে এক্সপোর্টে-মাথাপিছু আায়ে এগিয়ে, ভারতের সাথে পাল্লা দিচ্ছি সব দিক দিয়ে এবং এগিয়ে আছি অনেক ক্ষেত্রেই। মানি যে আরো অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের আরো অনেক উন্নতি করতে হবে, দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে হবে। মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে। টেকসই রাজনৈতিক ব্যবস্থা আনতে হবে। এভাবে আরো অনেক দুর যেতে হবে কিন্তু এটা মানতেই হবে যে শুরুটা করে দিয়েছে ওঁরা। এই যাত্রার বেশ খানিকতা এগিয়েও নিয়ে  গেছে ওঁরা। এখন এই যাত্রাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে - বাড়াতে হবে এর গতি।


প্রত্যেকটি জাতির উত্থান পতন আছেই, সেটাই মানব সভ্যতার ইতিহাস।এতে যেমন হতাশ হয়ে নিজ দেশের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে নেমে পড়ার দরকার নাই, তেমনি যখন একটা দেশ বা জাতি যখন জ্ঞানে-বিজ্ঞানে বা অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যায় তখন অহংকারে উদ্ধতও হয়ে উঠা- সমিচীন নয়। একসময় সুমেরীয়রা শুরু করেছিলো এক মহান সভ্যতা। মিশরের সভ্যতা তো কত হাজার বছরের পুরনো এবং এখনো নিগূঢ় রহস্যময়। তারপর এলো গ্রীক সভ্যতা, রোমান সভ্যতা, চৈনিক সভ্যতা, ভারতীয় সভ্যতা, মুসলমান সভ্যতা, মায়া-এযটেক সভ্যতা, আর সর্বশেষ ইউরোপিয়ান সভ্যতা। জাতিভিত্তক সভ্যতা আসে, কিছুদিন থাকে এবং একসময় চলেও যায়। কিন্তু এর সবকিছুর যোগফলই হলো আমাদের মানব সভ্যতা। সেই মানব সভ্যতার ভিশন সামনে রেখে আমাদের দেশকে আরো অনেক দুরে নিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের উন্নয়নের এই মডেল এখন প্রমানিত সত্য। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উন্নয়নের যাত্রার শিক্ষা পুরো পৃথিবীকে জানাতে হবে যাতে আমরা একসময় নিজেদের সাথে সাথে এই পৃথিবীর বাদ-বাকি মানুষগুলো যারা এখনো অন্ধকারে পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছে অথবা নির্যাতিত হচ্ছে মানুষরূপী অমানুষদের অশুভ শক্তির দ্বারা তাদেরকেও আমাদের উন্নয়ণের মুক্তির এই যাত্রার সঙ্গী করতে পারি। সেটাতেই হবে আমাদের চূড়ান্ত সাফল্য।

No comments:

Post a Comment