Saturday, November 19, 2022

বিশ্বকাপ ও বাংলাদেশের ফুটবল আর আমেরিকার বিশ্বচ্যাম্পিয়নশীপ

আমেরিকাতে প্রতি বছর বেইজবল ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশীপ হয়। প্রথম যখন সেই বিশ্ব  চ্যাম্পিয়নশীপের কথা শুনলাম, তার অল্প কিছুদিন আগে আমি এই দেশে এসেছিলাম। তাই তখনো দেশটার ভাও তেমন ভালো করে ধরতে পারি নাই। স্বাভাবিকভাবেই আমি ভাবলাম - নিশ্চয়ই পুরো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সবচেয়ে ভালো জাতীয় বেইজবল দলগুলো ওখানে কম্পিটিশন করবে। কিসের কী! পরে বুঝলাম ওখানে আমেরিকার ৫০ টা অঙ্গরাজ্যগুলোই শু়ধু অংশগ্রহণ করে। আমেরিকা নিজেদেরকে অনেকটা আলাদা পৃথিবী মনে করে। বাইরের পৃথিবী সম্মন্ধে ওদের ধারনা হয় খুব সীমিত অথবা উন্নাসিক। এটা প্রথম প্রথম বুঝতে না পারলেও, গত বছর আমি যখন আমেরিকার এই মাথা থেকে ওই মাথা পর্যন্ত ছয় হাজার মাইল গাড়ি চালিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম, তখন কিছুটা ধরতে পেরেছিলাম আমেরিকা আসলে কী। আমেরিকার ইতিহাসটা এর ভৌগলিক সীমার মতোই অনেক ছড়ানো, এটা একদিকে যেমন অনেক আশা-আকাঙ্খার এবং মানব সভ্যতার সাফল্যে গাথাঁ তেমনি আবার কোটি কোটি আদিবাসীর গনহত্যা, দাসপ্রথা তার শোষন-নিপীড়নের দূর্বিসহ চলমান ক্ষতচিত্রের এক চলমান স্মারকলিপি।


যাই হোক, যে কারনে এত কথার অবতারণার সেই আসল কথায় আসি। কিছুদিন পর আবার শুরু হচ্ছে বিশ্বকাপ ফুটবল। এটা এমন এক খেলা যেটাতে আমরা বরাবরই শেষের দিকে। আমরা কখনোই বিশ্বকাপ খেলিনি। বিশ্বকাপ দুরে থাক - এশিয়া কাপে খেলা ৩৫ টা দেশের পয়ন্ট তালিকার মধ্য আমাদের অবস্থান ৩৫ তম। আর ফিফার পয়েন্ট তালিকাতে আমরা ১৯২ তম।  তাহলে আমাদের ফুটবলের প্রতি এই ভালোবাসাটা কিভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে? অন্য দেশের জন্য, যারা অনেকেই হয়ত আমাদের দেশে কখনো আসেই নাই - অনেকে হয়ত আমাদের দেশের নামও ভালো করে উচ্চারণ করতে পারবে না, তাদের জন্য আমাদের এই চরমদেশপ্রমকে কি বলা যাবে? সেই ব্যাখ্যাতে পরে আসছি। বাস্তবতাটা হলো বিশ্বকাপ এলে পুরো দেশে এর আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বকাপ ফুটবল আমাদের কৃষ্টি-কালচারের মজ্জায় গাঁথা হয়ে গেছে। বাকি সবার মনের কথাতো আর আমি বলতে পারবো না, তাই নিজের কথাই বলি


আমি কোনো কালেই খুব ভালো ফুটবলার ছিলাম না। কিন্তু আট-দশটা সাধারন বাঙালির মতো আমারও ফুটবলের হাতেখড়ি (নাকি এটা পায়েখড়ি হবে?) হয়েছিল ছোটবেলায় - তখন আমার বয়স হবে পাঁচ কি ছয়। আনেক দিন ধরে চাওয়ার পর আম্মা আমাকে একটা মেরুন রঙের ফুটবল কিনে দিয়েছিলো। যেদিন ফুটবলটা কেনা হয়েছিল তার প্রথম দিনেই খেলতে যেয়ে ভাঙলাম আমার মায়ের খুবই শখের, জীবনের প্রথম বানানো, ড্রেসিংটেবিল এর কাচঁ। অনেকদিনের অল্প অল্প করে জমানো টাকায় কেনা অনেক শখের ড্রেসিংটেবল ছিলো সেটা। আমার মা কিন্তু আমাকে এতটুকু বকাঝকা করলো না। মায়েরা তো এমনই হয়! সেখানেই আমার ফুটবলের গল্পটা শেষ হলে হয়ত ভালোই হতো। কিন্তু সেদিন বিকেলেই আমার এক মামা তার বন্ধুদের সাথে সেই ফুটবলটা দিয়ে খেলতে গিয়ে সোজা ওটাকে তুলে মারলেন উপরের দিকে। আর সেটা গিয়ে উঠলো খেঁজুর গাছের মাথায়। চোখের সামনে আমার জীবনের প্রথম পাওয়া ফুটবলটা খেজুরের কাঁটাতে আটকে মূহুর্তে চুপসে গেল। ছোটোবেলার ওই "বড় বড়" কষ্টগুলো হয়ত কখনোই ভুলা যায়না। যাই হোক, সেটাই ছিলো আমার ছেলেবেলার প্রথম এবং শেষনিজেরফুটবল। এর পেছনে অর্থনৈতিক ব্যপারটাই ছিলো বড় তাই ছোটোবেলায় স্কুলের মাঠে অথবা পাড়ার খোলা জায়গায় আমার ফুটবল খেলা ছিলো অন্যদের বল দিয়েই। সবচেয়ে মজার খেলা ছিলো বৃষ্টিতে আর কাদায় ভরা মাঠে খেলা। তখন জ্বর-সর্দি বলে কিছু হতো বলে মনে পড়েনা। আরো অনেক অনেক বছর পরে যখন নিজে একটা ফুটবল কিনতে পারলাম ততদিনে ছেলেবেলার বয়সসীমা পার করে দিয়েছি বেশ আগেই। সময় পরিক্রমায় প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবল দেখার শুরু ৮৬-৯০ এ। তখন বেশির ভাগ বিশ্বকাপ খেলাই হতো ইউরোপ-আমেরিকায় তাই আমাদের দেশে বসে খেলা দেখতে হতো অনেক রাত করে। আমাদের বাড়িতে তখন টিভি ছিল না। তাই বিশ্বকাপ দেখার জন্য আগে থাকতেই প্ল্যান-প্রোগ্রাম করতে হতো। কার বাসায় যেয়ে খেলা দেখা হবে, আব্বা বাসায় থাকবে কিনা, কিভাবে যাবো, ইত্যাদি ইত্যাদি। নব্বইয়ে ম্যারাডোনার জন্য হয়ে গেলাম আর্জেনটিনার পাঁড় সমর্থক। ম্যারাডোনাকে যখন মাঠের মাঝে ক্যামেরুন, ব্রাজিল বা জার্মানীর কোনো খেলোয়ার ফাউল করতো আমার মতো অনেকেরেই হয়তো তখন মনে হতো ম্যারাডোনাকে না যেনো ওরা আমাকেই মেরেছে। কত চোখের পানি ফেলেছিনিজেরদলের জন্য। সময় বয়ে চলল কিন্তু আমি আর্জেন্টিনার সমর্থক হয়েই থাকলাম।


প্রথম দিকে দেশে বিশ্বকাপেরনিজের দেশেরপতাকা টাঙানোর প্রচলন তেমন করে ছিল না। সেটা যখন শুরু হলো, তখন থেকে বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হলেই দেশটা যেনো আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলে পরিনত হয়ে যায়। আমার মনে আছে ২০০৬ বিশ্বকাপের সময়ের কথা। আমার স্ত্রী আর আমার দুই বছরের মেয়েকে নিয়ে বিহারী ক্যাম্পে মোস্তাকিমের দোকানেচাপখেতে নিয়ে গেছি। ভিতরে জায়াগা না থাকায় বাইরের বেঞ্চে বসে খাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে আমার মেয়ে কি একটা দেখে চিৎকার করে উঠলো - “....! আজ্জেন্না!!!” আমরা তো বুঝেই পাইনা এইআজ্জেন্নাটা আবার কি জিনিষ। অনেক বুঝতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম কিন্তু আমার মেয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলেই চলল "আজ্জেন্না”... “আজ্জেন্না অবশেষে যেদিকে বার বার তাকাচ্ছিল, সামনের একটা চার-পাঁচতলা বিল্ডিং এর ছাদের দিকে, সেদিকে তাকিয়ে দেখি ওখানে কয়েকটা আর্জেন্টিনার পাতাকা টাঙানো - কোনো আর্জেন্টিনার সমর্থকের কাজ নিশ্চয়ই। তখন বুঝতে পারলাম "আজ্জেন্না" টা হলো "আর্জেন্টিনা। অতটুকুন একটা বাচ্চা আমাদের মুখে আর্জেন্টিনার কথা শুনতে শুনতে নিজেই আর্জেন্টিনার সাপোর্টার বনে গিয়েছিলো। তবে আমার সেদিন অবশ্য ভালোই লেগেছিল এইজন্য যে, আমার মেয়েও তার পৈতৃক লেগাসি ধরে রেখেছে।


একসময় আস্তে আস্তে সময় গড়ালো, দেশ ছেড়ে বিদেশে আসলাম। আমেরিকায় চারটা খেলা চলে বছরঘুরে: আমেরিকান ফুটবল (যেটা রাগবী নামে বাইরের দেশে পরিচিত), বেইজবল, বাস্কেটবল, এবং হকি (আইস হকিটাই বেশী জনপ্রিয়) তারপর হলোসকার” - আমরা সবাই যেটাকে বলি ফুটবল আমেরিকায় সেটাকে বলে সকার (soccer) কেন এই অদ্ভুতুরে নাম সেটার পেছনে আছে এক বিরাট ইতিহাস। সেই গল্পটা আপাতত তুলে রাখি অন্য কোনো সময়ের জন্য। আমি মাঝে মধ্যে মজা করে বলি যে- আমেরিকা পৃথিবীর একমাত্র জাতি যারা ফুটবল বিশ্বকাপ যেয়ে সকার খেলে আসে। প্রত্যেকটা দেশ জাতির ভালো দিক যেমন থাকে তেমনি কিছু মন্দ দিকও থাকে। আমরা যদি ভালোটা নিতে চাই তাহলে শুধু এর ভালোটাই দেখবো এবং ঠিক এর উল্টোটাও সত্যি। বয়সের সাথে সাথে আমার দেখার দৃষ্টিও মনে হয় কিছুটা গভীর হয়েছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবি বিশ্বকাপ নিয়ে আমাদের এই যে "অন্য দেশ" প্রেম, এটার উৎপত্তি কোথায় আর এটার কি কোনও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াই নেই? যদি থেকে থাকে তাহলে সেটা কী?


বিশ্বকাপ ফুটবলে অন্য দেশের জন্য এই "নিঃস্বার্থ ভালোবাসাটা যদি হতো দেশ-কাল-গোত্রের উর্ধে উঠে বিশ্বমানবতার জন্য তাহলে সেটা হতো সত্যিকারের এক অর্জন। কিন্ত আমরা জানি যে এই ব্যাপারটা ঠিক সেরকম না। আমার ধারণাটা হলো এর পেছনে এক জটিল মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার জড়িত। তা নাহলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, যাঁরা আমাদের সরাসরি প্রতিবেশী তাদেরকে গনহত্যা থেকে বাঁচনোর জন্য আমাদের এপ্রোচটা হতো আরেকটু অন্যরকম। আমি মনেপ্রাণে চাই আমার এই ধারণাটা ভুল। তবে এটা শুধু আমাদের দেশের ক্ষেত্রেই না বরং আমাদের আশেপাশের অনেক দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কথা। গত বিশ্বকাপ চলার সময় ভারতের এক সমর্থক তার "দেশের" হার সহ্য না করতে পেরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আমরা সবাই জানি যে ভারতও আমাদের মতো ফুটবলে বেশ পিছিয়ে। ফিফার তালিকায় ভারতীয়রা ১০৬ তম। তাহলে ওরাও কেনো বিশ্বকাপ নিয়ে এতদূর যাবে? তারমানে এই রোগটা শুধু আমাদের একারই নয় আরো অনেকেরই আছে।


কারন বিস্লেশনে যাওয়ার আগে একটা সমান্তরাল ছবি দেখাতে চাই। একবার চিন্তা করুন তো ভারতীয়রা বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড বা নেদারল্যান্ড কে সাপোর্ট করছেন। সেটা কি বিশ্বাসযোগ্য হবে? আমি আসলে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কথা বলছি। এটার উত্তর এতোই সহজ যে এর জন্য আমাদেরকে ভারতীয় হতে হবে না। উত্তরটা এক কথায়ই "না" এবার তাহলে একই প্রশ্ন আমাদের দেশের জন্য করা যাক। এক্ষেত্রেও উত্তরটাও খুব কঠিন না - "প্রশ্নই আসে না" কিন্তু এই একই প্রশ্ন আমি যদি ত্রিশ বছর আগে করতাম, তাহলে উত্তরটা কি একি রকম হতো? আমাদের সময়ে বা তার আগে, যখন বাংলাদেশ ক্রিকেটে বলার মতো কিছুই ছিলো না, তখন কি আমরা বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অন্যান্য দেশেকে সাপোর্ট করতাম না? যারা সেই সময় দেখেনি, সেই আজকের প্রজন্মের জন্য বলি- আমরা তখন কেউ পাকিস্তানকে, কেউ ভারতকে, আর কেউবা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে সাপোর্ট করতাম। এখন আমাদের মধ্যে কেউ যদি এমন কাজ করেন, বাংলাদেশ থাকা অবস্থায়, তাহলে নির্দ্ধিধায় তাকে হয়ত আমরা রাজাকার সার্টিফাইড করে দিব।


এখন আসুন প্রথম অংশে করা প্রশ্নের জবাব খুঁজতে যাই। এর পেছনে হাজার হাজার কারন থাকতে পারে আর আমার ধারণায় (ইংরেজিতে যাকে বলে ইনটিউশন) কারনগুলোর কয়েকটা হতে পারে:


  • দুইশ বছরের ঔপনিবেশিক শাষন আমাদের মেরুদন্ডের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। কয়েক প্রজন্ম ধরে চলা সেই অমর্যাদাকর-নির্যাতনের শাষন আমাদের "জীনোম" কে পরিবর্তিত করে ফেলেছে। এটা আমার কথা না, যেকোনো জীববিজ্ঞানী বা জিন-বিজ্ঞানীকে জিজ্ঞাসা করলেই আপনাকে বলে দেবে কিভাবে মানুষের জিন তার ব্যবহার-পরিবেশ দিয়ে প্রভাবিত হয় এবং বংশ পরম্পরায় হস্তান্তরিত হয়। তাই আমরা এবং আমাদের মতোই যারা ঔপনিবেশিক শাসনের শিকার তারা কোনো একভাবে বিদেশি (প্রথমতঃ সাদা চামড়ার তারপর অন্য জাতিগোষ্ঠীর) দেখলেই ভেতরে থাকা সেই "দাসত্বতাবোধ" আক্রান্ত হই কিন্তু আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা - কেন। এটা অনেকটা - যখন শরীরের মধ্যে সামান্য পরিমাণ ঠান্ডার ভাইরাস ঢুকে তখন আমাদের গা মেজমেজ করে কিন্তু আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা আসলেই শরীরটা খারাপ নাকি এটা স্বাভাবিক বিষাদগ্রস্ততা।
  • কিন্তু আমরাতো ব্রিটিশদের তাড়িয়েছি অনেক আগেই। তাহলে সেটা এতদিনেও কেন ঠিক হচ্ছে না? তাহলে আমাদের "জিনেটিক মিউটেশন" কি ঠিক-ঠাক কাজ করছে না? অবশ্যই করছে। তা নাহলে আমরা স্বাধীন হলাম কেমন করে! আমাদের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে - অনেক ক্ষেত্রেই সেটা দৃশ্যমান। তবে যেহেতু আমারা শুরু করেছি অনেক দেরি করে আর অনেক ধীর গতিতে তাই আমাদের এখনো পাড়ি দিতে হবে অনেকটা পথ, যেতে হবে অনেকদূর, তাই পরিবর্তন গুলো আসছে আস্তে-ধীরে, ছড়ানো-ছিটানোভাবে। ক্রিকেট একটা জালজুল্যমান উদাহরণ। আমাদের স্টেডিয়ামের গ্যালারি গুলো আর ভরে উঠেনা পাকিস্তান-ভারতের পতাকায় বরং গ্যলারি আর শরীর ভরে থাকে লাল-সবুজের পতাকায়।
  • আরেকটা কারন হতে পারে, আমাদের এর প্রভাব সম্মন্ধে অনবহিত থাকা অথবা অন্যভাবে বলা যায়, আমাদের অসচেতনতা জনিত অজ্ঞতা। আমরা আসলে খেয়ালই করিনা যে আমরা কি করছি বা কেন করছি। আর তার প্রভাব পড়ে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের উপর। ওরা তোতাপাখির মতো আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল-হল্যান্ডের সাপোর্টার বনে যায়। এটা কি জানেন যে আমাদের ব্রেইনের নিউরন গুলোর মধ্যে যে কানেকশন থাকে, যাকে জীববিজ্ঞানের ভাষায় বলে সিন্যপ্স, সেটা সবচেয়ে বেশি তৈরি হয় - বছরের মধ্যে। তারপরও সেটা চলতে থাকে কিন্তু তারপরে আস্তে আস্তে এর পরিমাণ কমতে থাকে। আর সেই সিন্যপ্স গুলো আরো অনেক কিছুর সাথে আমাদের "স্থায়ী আচরণ" কেমন হবে সেটা নির্ধারণ করে দেয়। তাই ছোটকালে আমরা যেভাবে বেড়ে উঠি তার একটা বড় প্রভাব পড়ে আমাদের পরবর্তী জীবনের উপর। তাই আপনি অতীতে যদি কখনো চিন্তা করে থাকেন যে কেনো ছোটবেলায় লেখাপড়া তারাতারি শিখতে পারতেন, যে কেনো নতুন জিনিস শিখতে সহজ হতো, আর কেনইবা একটা সময়ের পরে "স্থায়ী আচরণের" পরিবর্তন করা অনেকটা অসম্ভব- এখন আপনি জানেন কেন।
  • সর্বশেষ কারন হিসেবে বলা যায় এটা একটা পারিপার্শ্বিক বস্তুবাদীতার প্রভাব। আমরা কি জানি যে এই বিশ্বকাপ থেকে ফিফার উপার্জন কত হবে বলে তাদের ধারণা? পাঁচ বিলিয়ন ডলারের কিছু কম, ভাংতি করে বললে - . বিলিয়ন ডলার। তার মানে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি ডলার। বাংলাদেশেী টাকায় সেটা দাড়ায় ৪৮৩,৯৫৬,৬৫০,০০০ টাকা। এটা এক টাকার মহোৎসব। এর ভাগ যায় অনেকের কাছে - ফিফা, যারা খেলে, যারা খেলায়, যারা আয়োজন করে- আপনি আর আমি ছাড়া। তবে আমরাও এর অংশ তবে অন্যভাবে।এই উৎসবের টাকার যোগানদাতা হলাম আমরা। কিভাবে? আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা খেলা দেখি, খেলা নিয়ে কথা বলি (এই যেমন এখন বলছি), টিভি-ইন্টারনেট-ফেইসবুক-পত্রিকায় ঝড় তুলে চলি আর আমাদের কনজ্যুমার প্রোডক্ট কোম্পানিগুলো কোটি কোটি ডলার ঢালতে থাকে বিজ্ঞাপনের পেছনে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোকাকোলা দুই বিশ্বকাপে স্পন্সরশীপ বাবদ প্রায় ৮০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে, প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। এরকম আরও অনেক ছোট বড় কোম্পানি তো আছেই।তাই ওরা আমাদেরকে যেভাবেই হোক- বুঝিয়ে শুনিয়ে, দেখিয়ে-না দেখিয়ে, সাসপেন্স-ড্রামা তৈরি করে, লটারি পুরস্কার দিয়ে, গুজব ছড়িয়ে (ইংরেজিতে যেটাকে বলে Buzz), হেন রকম নেই যে ওরা চেষ্টা করবেনা।আমরা না দেখলে যে ওদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হবেনা।


আমরা ভাবতেই পারি যে, আরে ভাই এত কিছু চিন্তা করলে কি চলে? একটু খেলা দেখছি, বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডা-গল্প করছি সেটাতে আবার কী সমস্যা? সেটাতে আসলে কোনো সমস্যা না। আমরা যদি এই খেলার শারিরীক শৈল্পিক কৌশল গুলো দেখে নির্ভেজাল আনন্দ পাই, নিজেদের মনস্তাত্ত্বিক শারিরীক উন্নতিতে কাজে লাগাই, অথবা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে এই খেলায় এগিয়ে যেতে সাহায্য করি, সেই ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা তো না- উপরন্তু সেটা আমাদের সবার জন্য বেশ ভালোই হওয়ার কথা। আসলে সমস্যা হলো এর বাইরের মানুষদের ক্ষেত্রে। সেটা মোটা দাগে দুই ধরনে পরে। আমরা যারা হাজার হাজার টাকার অপচয় করছি এর পেছনে (পতাকা, জার্সি, রাস্তা-দেয়াল-বাড়ী রং বা লিখন), "নিজের" প্রিয় দেশের সাপোর্ট করতে যেয়ে নিজেকে বা বিশ্বকাপের "অন্যদেশের" সাপোর্টারদের কষ্ট দিচ্ছি, অথবা অনেকেই আমরা হার্টের রোগ বাঁধিয়ে বসছি, পরিক্ষা মিস করছি, জরুরী কাজে ফাঁকি দিচ্ছি, ইত্যাদি। এগুলো তো হলো শর্ট টার্ম প্রভাব। কিন্তু লংটার্ম প্রভাব কী হতে পারে? কয়েকটা কথা বলা যায়, যেমন-

  • আমাদের ঔপনিবেশিকতার প্রভাব কাটিয়ে উঠার প্রচেষ্টাতে আরো পিছিয়ে যাওয়া। কারন আমরা যখন আমাদের বোধবুদ্ধি বন্ধ করে দিয়ে কোন এক অজানা অচেনা দেশ যার সাথ আমাদের না আছে যোগাযোগ, আর না জানি ওদের ইতিহাস ঐতিহ্য, তাদের জন্য জান-কোরবান করে আমার নিজের "সত্যিকারের" দেশের মানুষদের কষ্ট দেই, নিজেকে কষ্ট দেই, তখন আমাদের মগজের আর জিনোমের মধ্যে "দাসত্বের শৃঙ্খল" টা শুধু আরেকটু পোক্তই হয়।
  • অন্যটা হলো, ম্যাটেরিয়ালিস্টিক বা ভোগবাদী জীবনে প্রভাবিত হয়ে যাওয়া। এটা অনেক গভীর একটা বিষয় তাই এই স্বল্প পরিসরে বলা সম্ভব নয়, তাই শুধু এর কয়েকটা করুণ পরিণতির কথাই বলে আমাদেরকে সতর্ক করার চেষ্টা করব: এই ভোগবাদী লাইফস্টাইল আমাদেরকে নিয়ে যায় যেখানে একমাত্র কাজ হচ্ছে কার চেয়ে কে বেশি উপার্জন করতে পারে তাই আমরা ঘুরপাক খেতে থাকি যত বেশি উপার্জন করা যায় সেই চক্রে এবং তার ফলে স্ট্রেসজনিত ব্লাড প্রেশার, ডায়াবেটিক, ডিপ্রেশনে, ইত্যাদির মধ্যে ডুবে যাই। সবচেয়ে ভয়ংকর প্রভাব যেটা নিয়ে আমরা সচরাচর কথা না বলতেই সাচ্ছন্দ্যবোধ করি আর সেটা হলো একমাত্র চিরসত্য -মৃত্যু, ইংরেজি প্রবাদে যেভাবে বলে "এলিফ্যান্ট ইন দ্যা রুম" - সেই মৃতুকে ভুলিয়ে দেওয়া আর আমাদের এই পৃথিবীতে আসার অভীষ্ট লক্ষ্য কী সেটা সন্মন্ধে বিস্মৃত রাখা।

আমরা এখানে এসেছি কয়েকটা মুহূর্তের জন্য। সওদাগরের মতো। শুধুমাত্র একটা পণ্য দিয়েই আমাদের পাঠানো হয়েছে। আর সেটা হলো "সময়"। সেই সময়কে বিক্রি করে পরবর্তী জীবনের ভোগ-বিলাসের উপকরণ জোগান করার জন্যই আমাদের এখানে আসা। কখনো ভেবেছেন কি, সেটা বেচে কী কিনলাম? আর কতইবা লাভ করলাম?


শেষমেষ একটা কথা বলেই ফেলি- অনেক ছোটবেলার ভালোবাসা তো তাই আমার হার্ডওয়্যার করা নিউরন-সিন্যপ্সের অনুরণন থেকে ভেসে আসে একটা সুপ্ত বাসনা- কাতার বিশ্বকাপের ট্রফিটা যেন আর্জেন্টিনার হাতেই যাক। 😛


#বিশ্বকাপ

#ফুটবল

#কাতারবিশ্বকাপ২০২২

No comments:

Post a Comment